নকশি কাঁথা : গ্রাম-বাঙলার অব্যক্ত সুখ-দুঃখের এক জীবন্ত আখ্যান
রূপাই আর সাজুর প্রেম কাহিনির সাথে বাঙালির নকশি কাঁথার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রাম্য এই প্রেমিক তরুণী সাজু তার স্বামীর অপেক্ষায় চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে বুনে চলে নকশি কাঁথা। সেখানে সে সূঁই-সুতোর আচর দিয়ে ফুটিয়ে তোলে তার মনের অব্যক্ত দুঃখ আর বেদনার কাহিনি। সাজুর আশা একদিন ঠিকই রূপাই ফিরে আসবে তার কাছে। কিন্তু রূপাই আর ফিরে আসে না। ততদিনে সাজু আর নেই। সাজুর বিরহে রূপাইও বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। সাজুর কবরের উপর পড়ে থাকে রূপাই। এমনি করুন কাহিনি ফুঠে উঠেছে জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে।
এভাবেই বাংলার নারীরা নকশি কাঁথায় সুঁই-সুতো দ্বারা বুনেছে স্বামী কিংবা প্রেমিকের বিরহের বা আনন্দের এক একটি গল্পগুচ্ছ। তারা নকশি কাঁথার জমিনে জীবন্ত করে ফুটে তুলেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা স্বামী, আত্মীয় স্বজন কিংবা পরিবার পরিজনের স্মৃতি কথাগুলো। এসব নকশি কাঁথায় গ্রাম-বাঙলার জীবন ও জগতের নানা রূপ প্রতীকের মাধ্যমে ফুটে তুলেছে গ্রামীণ নারীরা। আবহমান কাল ধরে নকশি কাঁথায় যে শিল্পকর্ম ফুটে ওঠেছে তা বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য। এভাবে একেকটি নকশি কাঁথার জমিনে লুকিয়ে থাকে বাঙলার মানুষের হাজারো গল্প। আর এসব গল্পে লুকিয়ে আছে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর ভালোবাসার স্মৃতি। বাঙলার পথে প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া গল্পকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের এই একেকটি নকশি কাঁথা।
নকশি কাঁথার অন্যতম বৈশিষ্ট একটির সঙ্গে অন্যটির মিল কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানেই নকশি কাঁথার নিজস্বতা। নকশি কাঁথা বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। এই ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করেই ১৯২৯ সালে জসীম উদ্দীন রচনা করেন তার নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থ। বলা যায় এরপর থেকেই সুধী মহলে নকশি কাঁথা শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে নকশি কাঁথার জন্ম কবে তার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা না গেলেও নকশি কাঁথা গবেষক পারভীন আহমেদ মনে করেন, সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি নারীরা নকশি কাঁথা সেলাই করে আসছে। পুরো বাংলাদেশেই নকশি কাঁথা তৈরি হয়, তবে কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ফরিদপুর, ও যশোর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত।
পরিবারে নতুন অতিথির আগমনের সংবাদ শুনার সঙ্গে সঙ্গে নানী-দাদীরা তৈরি করে নকশি কাঁথা। এই নতুন অতিথির জন্য কাঁথা তৈরির রেওয়াজ টিকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এখনও বিয়ের সময় মেয়ের উপহারের তালিকায় থাকে নকশি কাঁথা। সময়কে ধারণ করে নকশি কাঁথা এগিয়ে এসেছে আধুনিক মানুষের দোরগোড়ায়। বাংলাদেশে এটি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে সত্তরের দশকে। কিন্তু সেই সাথে সাথে নকশি কাঁথার অনেকটাই হারিয়েছে সেই ঐতিহ্যগত রূপ বা শৈল্পিক বৈশিষ্ট। আজ নকশি কাঁথার বাণিজ্যিক ব্যবহার সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। যার ফলে এটি ব্যবহার হচ্ছে বৈচিত্রপূর্ণ পণ্যেও।
বর্তমান বাংলাদেশে নানা রকমের নকশি কাঁথার পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নকশি কাঁথা, বিছানার চাদর, থ্রিপিস, নোটবুক, ফাইল ফোল্ডার, নারীদের হ্যান্ড ব্যাগ, ওয়াল ম্যাট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিস পাঞ্জাবি, ইয়র্ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, মাথার ব্যান্ড, মানিব্যাগ, কলমদানি, মোবাইল ফোন ব্যাগ, শাল ও চাদর প্রভৃতি।
গ্রাম-বাংলার নারী কারুশিল্পিদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সুঁইসুতোর কারুকাজে সমৃদ্ধ এসব নকশী কাঁথা পণ্য হতে পারে আপনার প্রিয়জনের বিশেষ কোন দিনের বিশেষ উপহার। তাই আসুন, বেশি বেশি করে নকশি কাঁথা পণ্য ব্যবহার করে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরি বিশ্ব দরবারে।